আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ফায়দা লুটতে চায় মিয়ানমার। সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে তারা রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার অজুহাত খুঁজছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ চরম ধৈর্যের পরিচয় দিচ্ছে।

ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশীদ আলম মঙ্গলবার বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিংকালে এসব কথা বলেন। মিয়ানমার যাতে এ অঞ্চলে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে না পারে সে লক্ষ্যে তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা কামনা করেন। এর আগে সোমবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর কূটনীতিকদের একই বিষয়ে ব্রিফ করা হয়েছিল। এসব ব্রিফিংয়ে চীন ও ভারতের কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।

সম্প্রতি মিয়ানমার সীমান্তে বিদ্রোহী গ্রুপ আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর লড়াইয়ের কারণে সীমান্তে উত্তেজনা দেখা দেয়। যদিও আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে অভিযান মিয়ানমারের অভ্যন্তরে ঘটছে; কিন্তু সেখান থেকে কিছু কিছু মর্টার শেল বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়ছে। এছাড়া গোলাগুলির শব্দে সীমান্তে বাংলাদেশের অধিবাসীদের মধ্যে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে চার দফা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। অন্যদিকে মিয়ানমারে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে ব্যাখ্যা দিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মিয়ানমার দাবি করছে, বাংলাদেশের ভূখণ্ডে পড়া মর্টার শেল আরাকান আর্মির। তারা এও বলেছে যে, বাংলাদেশে যেন আরাকান আর্মি ও আরসা সন্ত্রাসীরা ঠাঁই না পায়। জবাবে বাংলাদেশ বলেছে, বাংলাদেশ সন্ত্রাসের ব্যাপারে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। কোনো দেশের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে দেওয়া হয় না। এদিকে কক্সবাজার ও বান্দরবান থেকে আমাদের প্রতিনিধিরা জানাচ্ছেন, সীমান্তের ওপারে গোলাগুলির শব্দে বাংলাদেশে ভীতির সৃষ্টি হয়েছে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ ভূখণ্ডে যেসব মর্টার শেল পড়েছে, সেগুলো প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে নিশ্চিত হওয়া গেছে, এসব মর্টার শেল মিয়ানমার সেনাবাহিনীর। পরে এ পরীক্ষার ফল মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করা হয়। মিয়ানমার বিষয়টি স্বীকার করলেও দেশটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এগুলো আরাকান আর্মি চুরি করে নিয়েছে। তবে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, আরাকান আর্মি কোনোভাবেই বাংলাদেশের দিকে গোলাবর্ষণ করছে না। কারণ তাদের লক্ষ্যই হচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।

মঙ্গলবার বিদেশি কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব রিয়ার অ্যাডমিরাল (অব.) খুরশীদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যে উত্তেজনা বিরাজ করছে, যে প্রাণহানি ঘটছে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে আমরা মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে প্রথমেই বলেছি, আমাদের ভূখণ্ডে যে গোলা পড়ছে তা বন্ধ করুন। পরবর্তীকালে আমরা আসিয়ান দেশগুলোকেও একইভাবে অনুরোধ করেছি যাতে মিয়ানমারের গোলা বাংলাদেশের ওপর না আসে সে বিষয়ে চেষ্টা করেন। বাংলাদেশের জনগণের ওপর চাপ না আসে। আজকে যারা এসেছিলেন, অন্যান্য রাষ্ট্রদূত তাদের বলেছি, আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়েছি ৫ বছর হয়ে গেল। তারা একটা রোহিঙ্গাও আজ পর্যন্ত ফেরত নেয়নি। প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, আমরা ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, বিদেশি রাষ্ট্রদূতরা আমাদের ধৈর্য ধরাকে স্বাগত জানিয়েছেন। আমরা যে কোনো উসকানিতে পা দিচ্ছি না সেটাকে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা তাদের রাজধানীতে এ বিষয়গুলো জানাবেন। ভবিষ্যতে জাতিসংঘে কিছু করণীয় থাকলে তারা আমাদের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। মিয়ানমার ইচ্ছাকৃতভাবে এসব করছে কিনা জানতে চাইলে খুরশীদ আলম বলেন, সেটা আমাদের ধর্তব্যের বিষয় নয়। ইচ্ছা করেই করুক বা যা কিছুই করুক, আমরা মনে করি, এটা এ অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে ফেলবে।

মিয়ানমারের মহাপরিচালক বলেন, ৭ সেপ্টেম্বর কূটনৈতিক চ্যানেলের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভেতরে আরাকান আর্মি ও আরসার ঘাঁটি রয়েছে বলে অভিযোগ অবহিত করা হয়েছে। এগুলোকে ভেঙে দেওয়ার জন্য ওই আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করা হয়েছে।

জুলাই থেকে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী ও সে দেশের বিদ্রোহী সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির মধ্যে চলা সংঘাতে অস্থির হয়ে উঠেছে রাখাইন রাজ্য।
সংঘাতের প্রভাবে আতঙ্ক ছড়িয়েছে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলে, তিন দফায় মায়ানমার থেকে নিক্ষেপিত মর্টার শেল পতিত হয়েছে উখিয়ার পার্শ্ববর্তী বান্দরবানের ঘুমধুমে। সর্বশেষ, এক রোহিঙ্গা নিহত ও ৬ জন আহত হওয়ার ঘটনায় উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, তুমব্রু এলাকাটি দুভাগে বিভক্ত করায় সীমান্ত ঘেঁষে মানুষের বসতি পড়ে গেছে। সীমান্তের এপারে-ওপারে উভয় ভূ-খণ্ডেই তুমব্রু এলাকা রয়েছে। তুমব্রু সীমান্তের মিয়ানমার অংশে মূলত গোলাগুলি হচ্ছে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান আর্মির (এএ) সঙ্গে মিয়ানমার সরকারি বাহিনীর। দুপক্ষের সংঘাতে মাঝেমধ্যেই মর্টার শেল এবং ভারী অস্ত্রের গুলি এসে পড়ছে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে। স্বাভাবিক মনে হলেও সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থিতিশীল। ক্রমশ ভয়ংকর হয়ে উঠছে গোলাগুলির শব্দ।